আর কত নিপীড়ণ সইবে কাশ্মীর ? কাঙ্খিত আজাদী কতদূর ?
আর কত নিপীড়ন সইবে কাশ্মীর? কাঙ্ক্ষিত আজাদী কতদিন?
আল্লামা মামুনুল হক সাহেবের টাইম লাইন থেকে সংগ্রহীত ।
আফগান ও মুঘল আমলে কাশ্মীর ছিল মুসলিম শাসনাধীন এলাকা ৷ ১৮১৯ সালে পাঞ্জাবের শিখ রাজা রণজিৎ সিং কাশ্মীর কে করায়ত্ত করে ৷ ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে শিখ রাজা দুলিপ সিং পরাস্ত হলে কাশ্মীর ও জম্মু বৃটিশ শাসনাধীন হয় ৷ পরে যুদ্ধে সহযোগিতার পুরস্কারস্বরূপ গুলাব সিংয়ের কাছে - যিনি কার্যত ছিলেন শিখ রাজ্যের অধিনস্ত জম্মুর শাসক, ৭৫ লাখ নানকারশাহী (শিখ সাম্রাজ্যের মুদ্রা) নগদ অর্থের বিনিময়ে কাশ্মীরকে বিক্রি করে দেয় বৃটিশ কোম্পানী ৷ হিন্দু-রাজপূত ডোগরা বংশের শাসক গুলাব সিংয়ের রাজত্বের মধ্য দিয়ে জম্মু কাশ্মীর লাদাখ নিয়ে একটি অভিন্ন রাজনৈতিক ভূখণ্ডের যাত্রা শুরু হয় ৷ তিনটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হলেও অঞ্চলটি বর্তমানে জম্মু-কাশ্মীর নামে ভারতের অন্তর্গত একটি প্রদেশের মর্যাদাপায় ৷ এই তিন অঞ্চলের জনসংখ্যার অনুপাতও ভিন্ন ভিন্ন ৷ কাশ্মীরের বর্তমান জনসংখ্যা ৭০ লাখের প্রায় ৯৫ ভাগ মুসলমান ৷ অপরদিকে জম্মুর জনসংখ্যা ৫৪ লাখ, যার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ হিন্দু ৷ আর লাদাখের জনসংখ্যা তিন লক্ষ যার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ৷ বর্তমান হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জম্মু মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাই ছিল ৷ ১৯৪১ সালের আদমশুমারীতে দেখা যায় ২০ লাখ জনসংখ্যায় মুসলমান ছিল ১২ লক্ষাধিক ৷ ১৯৪৭ সালের আগে পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক মুসলমান দেশত্যাগ করে পাকিস্তানের বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় চলে যায় ৷ আর সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে জম্মুর দশ জেলার মধ্য থেকে কেবল তিনটি জেলা নিয়ে আজাদ কাশ্মীর হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় ৷
কাশ্মীরী মুসলমানদের বঞ্চনার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ ৷ ১৮১৯ থেকে ১৮৪৬ সাতাশ বছরের শিখ সাম্রাজ্যে নানা ধরণের নিপীড়ণের শিকার ছিল কাশ্মীরের মুসলমানরা ৷ প্রায় শতভাগ মুসলিম অধ্যুসিত কাশ্মীরে ২৭ বছরে ১০ জন গভর্ণরের মধ্যে ৮ জনই ছিলেন অমুসলিম ৷ রূঢ় করব্যবস্থার পাশাপাশি ধর্মপালনেও ছিল প্রতিবন্ধকতা ৷ এ সময় অন্তত দুই দশক কাশ্মীরের প্রধান মসজিদে এবাদত নিষিদ্ধ ছিল ৷ ২৭ বছরের শিখ রাজত্বের অবসানের পর ১৮৪৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ডোগরা রাজপূত-হিন্দুদের শতবছরের শাসনকাল তো ছিল মুসলমানদের জন্য আরো বেশি পীড়ণমূলক ৷ ডোগরা রাজত্বের স্থপতি হিন্দু রাজা গুলাব সিং কাশ্মীরকে বৃটিশ কোম্পানী থেকে খরিদ করেছিলেন নগদ অর্থের বিনিময়ে ৷ কাশ্মীরী জনতা নিজেদের অজান্তেই মাত্র ৭৫ লাখ মুদ্রায় বিক্রি হয়েছিল ৷ আর তাই ডোগরা রাজারা একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করত এই অঞ্চলের মানুষ ও সম্পদের ওপর ৷ ইচ্ছা মাফিক কর আরোপ করত রাজারা এবং তাই মেনে নিতে হত জনগণকে ৷
অব্যাহত এই নিপীড়ণ ও বৈষম্যের কারণে মুসলমানদের মধ্যে পুঞ্জিভূত হতে থাকে ক্ষোভ ৷ এ থেকেই ১৯৩১ সালে কাশ্মীরের মুসলমান প্রজারা রাজার বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক নীতি ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ৷ গণ আন্দোলনে রূপ নেয়া এই বিদ্রোহের প্রেক্ষিতেই ১৯৩২ সালে কাশ্মীরী মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় "মুসলিম কনফারেন্স" ৷ প্রথমে মুসলিম কনফারেন্স এবং পরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের মাধ্যমে কাশ্মীরী মুসলমানদের নেতা হিসাবে সামনে চলে আসেন শেখ আব্দুল্লাহ্ ৷ মুসলমানদের এই রাজনৈতিক উত্থানের প্রেক্ষিতে "প্রজা সভা" নামক একটি জনপ্রতিনিধি পরিষদ গঠনের ঘোষণা দেয় রাজা ৷ ১৯৪৪ সালে রাজা হরি সিং প্রথমবারের মত "প্রজা সভা" থেকে দুজন মন্ত্রী তার মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিলে শেখ আব্দুল্লাহ মন্ত্রী হন ৷ এ সময়টাতে ভারতবর্ষ জুড়ে বৃটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রাম তুঙ্গে ওঠে ৷ মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি আর ন্যাশনাল কংগ্রেসের অবিভক্ত ভারত দর্শন ছিল তখন আলোচনার পাদপ্রদীপে ৷ অবশেষে ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে, তখনো কাশ্মীর ছিল দোদূল্যমান ৷ কাশ্মীরের স্বাধীন হওয়া, ভারতে যুক্ত হওয়া কিংবা পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার মত তিনটি বিকল্প ছিল ৷ কাশ্মীরের সাধারণ জনতার আকাঙ্খা ছিল স্বাধীন হওয়া বা মুসলিম আবাসস্থল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া ৷ কিন্তু ক্ষমতাসীন হিন্দু রাজা হরি সিংরা চাইছিল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে ৷ স্বাধীনতাকালীন ১৯৪৭ এর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্তের বিরোধ একদিকে পাক-ভারত যুদ্ধে গড়ায়, অপরদিকে হিন্দু রাজা হরি সিং দিল্লীর সাথে যোগসাজশ করে শেখ আব্দুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে দেন ৷ এক দিকে জন আকাঙ্খা আর নেতৃত্বের টানা-পোড়েনে দুলছিল কাশ্মীর, অন্য দিকে সীমান্তের যুদ্ধ ছিল অব্যাহত, এমন সময়ে কাশ্মীরের জনগণের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে জওহার লাল নেহেরু অঙ্গীকার করেছিলেন যে, শিঘ্রই গণভোটের আয়োজন করা হবে এবং কাশ্মীরীরাই নির্ধারণ করবে কাশ্মীরের ভাগ্য ৷
১৯৪৮ সালে কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপিত হয় জাতি সংঘে ৷ জাতিসংঘ থেকেও গণভোট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ৷ কিন্তু ভারত বরাবরই নানা ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রতিশ্রুতিভঙ্গের পথে হেটেছে ৷ দেশবিভাগ ও তৎপরবর্তি সময়কালীন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে কাশ্মীরকে ভারতের সাথে যুক্ত রাখার প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা ছিল সাংবিধানিকভাবে জম্মু-কাশ্মীরের কিছু স্বতন্ত্র মর্যাদা ৷ ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ আলোচিত এমন দুটি অনুচ্ছেদ হলো ৩৭০ ও ৩৫-এ ৷ অনুচ্ছেদ ৩৭০ জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ ধরণের স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিল ৷ দিয়েছিল নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা ৷ এই অনুচ্ছেগ অনুযায়ী প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পররাষ্টেরনীতি ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনার বাকী বিষয়গুলোর এখতিয়ার স্থানীয় আইনসভার ছিল ৷ আর অনুচ্ছেদ ৩৫-এ অনুযায়ী স্থায়ী বাসিন্দা নির্ধারণ, তাদের বিশেষ মর্যাদা সংরক্ষণ ও বাইরের কারো জমির মালিকানা অর্জনে বিধিনিষেধ আরোপের এখতিয়ার ছিল স্থানীয় আইনসভার ৷ অবশেষে চলতি ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে একতরফাভাবে বিতর্কিত কায়দায় সংবিধান থেকে ৩৭০ ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ দুটি বিলোপ করে নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদি বিজেপি সরকার ৷ কাশ্মীরের নিজস্ব আইনসভার অনুমোদনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও আইনসভা বর্তমান না থাকায় প্রেসিডেন্টকে দিয়ে অনুমোদন দেয়ার বিতর্কিত পন্থায় মোদি সরকার অনুচ্ছেদ দুটি বিলোপের বিল পাশ করে ৷ আর এর মাধ্যমে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আরেক দফা কাশ্মীরী জনগণের উপর নেমে আসে জুলুম ও বঞ্চনার খড়গ ৷
বতর্কিত বিলটি পাশ করার আগ থেকেই অনুমান করা হয়েছিল যে, কাশ্মীরের গণমানুষের নিকট বিষয়টি গ্রহনযোগ্য হবে না এবং তারা এটি মেনে নিবে না ৷ আর তাই ভারত সরকার কাশ্মীরের বিরুদ্ধে জবরদস্তি ও উৎপীড়ণমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে ৷ বিলটি পাশের আগেই কাশ্মীরে ব্যপক সেনা মোতায়েন করে কার্যত কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয় ৷ কার্ফ্যু জারি করা হয় শহর জুড়ে ৷ ইন্টারনেট বন্ধ করে বহির্বিন্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় গোটা জনপদকে ৷ অতপর ভূতুড়ে সেই জনপদে ভারতীয় বাহিনী হামলে পড়ে নারকীয় বর্বরতায় ৷ বিশেষ করে কাশ্মীরী মুসলিম যুবকদের ধরে ধরে গুম করে ফেলা হচ্ছে ৷
সম্ভাব্য প্রতিরোধ সংগ্রামকে দুর্বল করে দেয়ার নিমিত্তে পরিচালিত এই বর্বরতা কি কাশ্মীরের আযাদীর আকাঙ্খা দমিয়ে দেয়, নাকি আরো উস্কে দেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয় ৷
দমন-পীড়ন চালিয়ে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি শুধু কাশ্মীরেই নয় সারা ভারত জুড়েই মুসলিম জাতির ভবিষ্যতের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ৷ ভারতের চলমান এই নীতির প্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির উপর প্রতিষ্ঠিত বিশাল ভারতের ভহিষ্যতই মূলত হুমকির সম্মুখীন ৷
আল্লামা মামুনুল হক সাহেবের টাইম লাইন থেকে সংগ্রহীত ।
আফগান ও মুঘল আমলে কাশ্মীর ছিল মুসলিম শাসনাধীন এলাকা ৷ ১৮১৯ সালে পাঞ্জাবের শিখ রাজা রণজিৎ সিং কাশ্মীর কে করায়ত্ত করে ৷ ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে শিখ রাজা দুলিপ সিং পরাস্ত হলে কাশ্মীর ও জম্মু বৃটিশ শাসনাধীন হয় ৷ পরে যুদ্ধে সহযোগিতার পুরস্কারস্বরূপ গুলাব সিংয়ের কাছে - যিনি কার্যত ছিলেন শিখ রাজ্যের অধিনস্ত জম্মুর শাসক, ৭৫ লাখ নানকারশাহী (শিখ সাম্রাজ্যের মুদ্রা) নগদ অর্থের বিনিময়ে কাশ্মীরকে বিক্রি করে দেয় বৃটিশ কোম্পানী ৷ হিন্দু-রাজপূত ডোগরা বংশের শাসক গুলাব সিংয়ের রাজত্বের মধ্য দিয়ে জম্মু কাশ্মীর লাদাখ নিয়ে একটি অভিন্ন রাজনৈতিক ভূখণ্ডের যাত্রা শুরু হয় ৷ তিনটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হলেও অঞ্চলটি বর্তমানে জম্মু-কাশ্মীর নামে ভারতের অন্তর্গত একটি প্রদেশের মর্যাদাপায় ৷ এই তিন অঞ্চলের জনসংখ্যার অনুপাতও ভিন্ন ভিন্ন ৷ কাশ্মীরের বর্তমান জনসংখ্যা ৭০ লাখের প্রায় ৯৫ ভাগ মুসলমান ৷ অপরদিকে জম্মুর জনসংখ্যা ৫৪ লাখ, যার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ হিন্দু ৷ আর লাদাখের জনসংখ্যা তিন লক্ষ যার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ৷ বর্তমান হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জম্মু মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাই ছিল ৷ ১৯৪১ সালের আদমশুমারীতে দেখা যায় ২০ লাখ জনসংখ্যায় মুসলমান ছিল ১২ লক্ষাধিক ৷ ১৯৪৭ সালের আগে পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক মুসলমান দেশত্যাগ করে পাকিস্তানের বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় চলে যায় ৷ আর সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে জম্মুর দশ জেলার মধ্য থেকে কেবল তিনটি জেলা নিয়ে আজাদ কাশ্মীর হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় ৷
কাশ্মীরী মুসলমানদের বঞ্চনার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ ৷ ১৮১৯ থেকে ১৮৪৬ সাতাশ বছরের শিখ সাম্রাজ্যে নানা ধরণের নিপীড়ণের শিকার ছিল কাশ্মীরের মুসলমানরা ৷ প্রায় শতভাগ মুসলিম অধ্যুসিত কাশ্মীরে ২৭ বছরে ১০ জন গভর্ণরের মধ্যে ৮ জনই ছিলেন অমুসলিম ৷ রূঢ় করব্যবস্থার পাশাপাশি ধর্মপালনেও ছিল প্রতিবন্ধকতা ৷ এ সময় অন্তত দুই দশক কাশ্মীরের প্রধান মসজিদে এবাদত নিষিদ্ধ ছিল ৷ ২৭ বছরের শিখ রাজত্বের অবসানের পর ১৮৪৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ডোগরা রাজপূত-হিন্দুদের শতবছরের শাসনকাল তো ছিল মুসলমানদের জন্য আরো বেশি পীড়ণমূলক ৷ ডোগরা রাজত্বের স্থপতি হিন্দু রাজা গুলাব সিং কাশ্মীরকে বৃটিশ কোম্পানী থেকে খরিদ করেছিলেন নগদ অর্থের বিনিময়ে ৷ কাশ্মীরী জনতা নিজেদের অজান্তেই মাত্র ৭৫ লাখ মুদ্রায় বিক্রি হয়েছিল ৷ আর তাই ডোগরা রাজারা একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করত এই অঞ্চলের মানুষ ও সম্পদের ওপর ৷ ইচ্ছা মাফিক কর আরোপ করত রাজারা এবং তাই মেনে নিতে হত জনগণকে ৷
অব্যাহত এই নিপীড়ণ ও বৈষম্যের কারণে মুসলমানদের মধ্যে পুঞ্জিভূত হতে থাকে ক্ষোভ ৷ এ থেকেই ১৯৩১ সালে কাশ্মীরের মুসলমান প্রজারা রাজার বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক নীতি ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ৷ গণ আন্দোলনে রূপ নেয়া এই বিদ্রোহের প্রেক্ষিতেই ১৯৩২ সালে কাশ্মীরী মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় "মুসলিম কনফারেন্স" ৷ প্রথমে মুসলিম কনফারেন্স এবং পরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের মাধ্যমে কাশ্মীরী মুসলমানদের নেতা হিসাবে সামনে চলে আসেন শেখ আব্দুল্লাহ্ ৷ মুসলমানদের এই রাজনৈতিক উত্থানের প্রেক্ষিতে "প্রজা সভা" নামক একটি জনপ্রতিনিধি পরিষদ গঠনের ঘোষণা দেয় রাজা ৷ ১৯৪৪ সালে রাজা হরি সিং প্রথমবারের মত "প্রজা সভা" থেকে দুজন মন্ত্রী তার মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিলে শেখ আব্দুল্লাহ মন্ত্রী হন ৷ এ সময়টাতে ভারতবর্ষ জুড়ে বৃটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রাম তুঙ্গে ওঠে ৷ মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি আর ন্যাশনাল কংগ্রেসের অবিভক্ত ভারত দর্শন ছিল তখন আলোচনার পাদপ্রদীপে ৷ অবশেষে ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে, তখনো কাশ্মীর ছিল দোদূল্যমান ৷ কাশ্মীরের স্বাধীন হওয়া, ভারতে যুক্ত হওয়া কিংবা পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার মত তিনটি বিকল্প ছিল ৷ কাশ্মীরের সাধারণ জনতার আকাঙ্খা ছিল স্বাধীন হওয়া বা মুসলিম আবাসস্থল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া ৷ কিন্তু ক্ষমতাসীন হিন্দু রাজা হরি সিংরা চাইছিল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে ৷ স্বাধীনতাকালীন ১৯৪৭ এর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্তের বিরোধ একদিকে পাক-ভারত যুদ্ধে গড়ায়, অপরদিকে হিন্দু রাজা হরি সিং দিল্লীর সাথে যোগসাজশ করে শেখ আব্দুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে দেন ৷ এক দিকে জন আকাঙ্খা আর নেতৃত্বের টানা-পোড়েনে দুলছিল কাশ্মীর, অন্য দিকে সীমান্তের যুদ্ধ ছিল অব্যাহত, এমন সময়ে কাশ্মীরের জনগণের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে জওহার লাল নেহেরু অঙ্গীকার করেছিলেন যে, শিঘ্রই গণভোটের আয়োজন করা হবে এবং কাশ্মীরীরাই নির্ধারণ করবে কাশ্মীরের ভাগ্য ৷
১৯৪৮ সালে কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপিত হয় জাতি সংঘে ৷ জাতিসংঘ থেকেও গণভোট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ৷ কিন্তু ভারত বরাবরই নানা ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রতিশ্রুতিভঙ্গের পথে হেটেছে ৷ দেশবিভাগ ও তৎপরবর্তি সময়কালীন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে কাশ্মীরকে ভারতের সাথে যুক্ত রাখার প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা ছিল সাংবিধানিকভাবে জম্মু-কাশ্মীরের কিছু স্বতন্ত্র মর্যাদা ৷ ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ আলোচিত এমন দুটি অনুচ্ছেদ হলো ৩৭০ ও ৩৫-এ ৷ অনুচ্ছেদ ৩৭০ জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ ধরণের স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিল ৷ দিয়েছিল নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা ৷ এই অনুচ্ছেগ অনুযায়ী প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পররাষ্টেরনীতি ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনার বাকী বিষয়গুলোর এখতিয়ার স্থানীয় আইনসভার ছিল ৷ আর অনুচ্ছেদ ৩৫-এ অনুযায়ী স্থায়ী বাসিন্দা নির্ধারণ, তাদের বিশেষ মর্যাদা সংরক্ষণ ও বাইরের কারো জমির মালিকানা অর্জনে বিধিনিষেধ আরোপের এখতিয়ার ছিল স্থানীয় আইনসভার ৷ অবশেষে চলতি ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে একতরফাভাবে বিতর্কিত কায়দায় সংবিধান থেকে ৩৭০ ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ দুটি বিলোপ করে নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদি বিজেপি সরকার ৷ কাশ্মীরের নিজস্ব আইনসভার অনুমোদনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও আইনসভা বর্তমান না থাকায় প্রেসিডেন্টকে দিয়ে অনুমোদন দেয়ার বিতর্কিত পন্থায় মোদি সরকার অনুচ্ছেদ দুটি বিলোপের বিল পাশ করে ৷ আর এর মাধ্যমে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আরেক দফা কাশ্মীরী জনগণের উপর নেমে আসে জুলুম ও বঞ্চনার খড়গ ৷
বতর্কিত বিলটি পাশ করার আগ থেকেই অনুমান করা হয়েছিল যে, কাশ্মীরের গণমানুষের নিকট বিষয়টি গ্রহনযোগ্য হবে না এবং তারা এটি মেনে নিবে না ৷ আর তাই ভারত সরকার কাশ্মীরের বিরুদ্ধে জবরদস্তি ও উৎপীড়ণমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে ৷ বিলটি পাশের আগেই কাশ্মীরে ব্যপক সেনা মোতায়েন করে কার্যত কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয় ৷ কার্ফ্যু জারি করা হয় শহর জুড়ে ৷ ইন্টারনেট বন্ধ করে বহির্বিন্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় গোটা জনপদকে ৷ অতপর ভূতুড়ে সেই জনপদে ভারতীয় বাহিনী হামলে পড়ে নারকীয় বর্বরতায় ৷ বিশেষ করে কাশ্মীরী মুসলিম যুবকদের ধরে ধরে গুম করে ফেলা হচ্ছে ৷
সম্ভাব্য প্রতিরোধ সংগ্রামকে দুর্বল করে দেয়ার নিমিত্তে পরিচালিত এই বর্বরতা কি কাশ্মীরের আযাদীর আকাঙ্খা দমিয়ে দেয়, নাকি আরো উস্কে দেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয় ৷
দমন-পীড়ন চালিয়ে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি শুধু কাশ্মীরেই নয় সারা ভারত জুড়েই মুসলিম জাতির ভবিষ্যতের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ৷ ভারতের চলমান এই নীতির প্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির উপর প্রতিষ্ঠিত বিশাল ভারতের ভহিষ্যতই মূলত হুমকির সম্মুখীন ৷
মন্তব্যসমূহ