প্রশান্তের অবৈধ সম্পদের তালিকা দেখে বিস্মিত দুদক।
এইচ,এম ইমরান কাজী
জার্নালীষ্ট তাওহীদ নিউজ২৪.এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদারের (৫৩) নামে-বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বহর দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান দল। প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রশান্তের ৮ প্রতিষ্ঠান, চার বাল্যবন্ধু, তার মা, নিজ ও স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও দুদক আইনে মামলা করা হয়েছে। মামলার বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, চাকরি জীবনে প্রশান্ত বেতনভাতাসহ বৈধপথে আয় করেছেন ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অথচ তার সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ২৮৭ কোটি কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকা বলে জানা গেছে, যা অবৈধ আয়। এছাড়া তার নিজ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ১৬৩৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা করেছেন, যা বিভিন্ন সময় তুলে নিয়েছেন। এটি অর্থপাচার আইনে অপরাধ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী গতকাল শনিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রশান্ত কুমার হালদারের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি। মামলার তদন্তকালে সেগুলো আইনামলে নেওয়া হবে।’ প্রশান্তের সম্পদের বহর বিস্ময়কর মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এসব সম্পদ করা হয়েছে বেনামে ও তার বাল্যবন্ধুসহ নিজের পরিচিতদের নামে।’
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, পিরোজপুরের নাজিরপুর দিঘিরজান গ্রামের প্রণাবিন্দ হালদারের ছেলে প্রশান্ত কুমার হালদার এনআরবি (নন-রেসিডেন্স বাংলাদেশি) গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি। তার ঢাকার ঠিকানা ধানম-ির ১ নম্বর রোডে ও শ্যামলীর রিং রোডে। তিনি কয়েকটি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ে কর্মরত থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে এই সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার নিজ নামে ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাংক হিসাবে ১৬৩৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নিজ নামের বিভিন্ন হিসাবে ২৪০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, তার মা লীলাবতী হালদারের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে ১৬০ কোটি টাকা এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে আরও ১২৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা হয়েছে।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে দুদক যেসব সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা তৈরি করে প্রশান্তের নাম সেখানে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশান্তের নামে-বেনামে পাহাড়সম সম্পদের তথ্য পায় দুদক। তার ব্যাংক হিসাবসংক্রান্ত তথ্য, আয়কর অফিস ও সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে সম্পদ-সম্পর্কিত তথ্য এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে বলা হয়, প্রশান্তর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির এমডি উত্তম কুমার মিস্ত্রি ও অংশীদার তার স্ত্রী রচনা মণ্ডল। এছাড়া আরেকটি প্রতিষ্ঠান পিঅ্যান্ডএল কোম্পানির চেয়ারম্যান হলেন উদ্দাব মল্লিক ও এমডি সোমা ঘোষ। সংঘবিধি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকানা হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের, যার প্রকৃত মালিক প্রশান্ত। এসব প্যাড-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে প্রশান্তর ১২৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে। লিপরো ইন্টারন্যাশনালের নামে রাজধানীর তেজতুরী বাজারে ১১০ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে, যার দাম ১২৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। বেনামে কেনা ওই জমির তথ্য তিনি আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি।
ময়মনসিংহের ভালুকা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দুদক জানতে পারে, ভালুকার হাতীবেড় ও উথুরা মৌজায় ৯টি দলিলে ৫৮৯ শতাংশ জমি নিজ নামে কিনেছেন প্রশান্ত। এগুলোর দলিলমূল্য ১ কোটি ৩৪ হাজার টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত বাজারমূল্য অনেক বেশি, যা পরবর্তী সময়ে তদন্তে আইনামলে নেওয়া হবে জানিয়েছে দুদক।
অনুসন্ধানে দুদক জানতে পেরেছে, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড ও পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনালের রাজীব সৌম ও তার স্ত্রী শিমু রায়ের নামে ৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকার বিনিয়োগ আছে, যার প্রকৃত মালিক প্রশান্ত। এছাড়া সুখাদা লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানে এপিকে হালদার, অবন্তিকা বড়াল, প্রীতিষ কুমার হালদার ও সুস্মিতা সাহার নামে মোট ৩০ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির নামে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও অমিতাভ অধিকারীর নামে বিনিয়োগ আছে ৩০ লাখ টাকা। সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের সিদ্দিকুর রহমান ও তার স্ত্রী মাহফুজা রহমানের দুই ছেলে নিয়াজ রহমান সাকিব ও ইসতিয়াক রহমান ইমরান, অন্য কর্মকর্তা ইনসান আলী শেখের নামে মোট ২৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে, যার প্রকৃত মালিক প্রশান্ত।
প্রশান্ত কুমারের আজিজ ফেব্রিকসের নামে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল ও রামপ্রসাদ রায়ের নাম ব্যবহার করে বেনামে ৬২ লাখ ৮৮ হাজার টাকার বিনিয়োগ করেছেন প্রশান্ত। আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের নামে অভিজিৎ অধিকারী তীর্থ ও প্রীতিষ কুমার হালদারদের নাম ব্যবহার করে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার বিনিয়োগ করেন প্রশান্ত।
একইভাবে ক্লিউইস্টন ফুড অ্যান্ড অ্যাকোমোডেশন লিমিটেডের নামে আবদুল আলিম চৌধুরী, জাহাঙ্গীর আলম, সিদ্দিকুর রহমান, রতন কুমার বিশ্বাস, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, অমিতাভ অধিকারী, সিমটেক্স টেক্সটাইল জেড এ অ্যাপারেলস, আলমগীর হোসেন, পিঅ্যান্ডএল এগ্রো ফার্মস, আনান কেমিক্যালস ও উইনমার্ক লিমিটেডের নামে প্রশান্তর বিনিয়োগ আছে ৩১ কোটি ৪৫ লাখ ২৬ হাজার ৪০০ টাকা।
এ ছাড়া রহমান কেমিক্যালস লিমিটেডে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, রেপটাইলস ফার্ম, আর্থস্কোপ লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, রহমান কেমিক্যালস, রতন কুমার বিশ্বাস, রাজীব সৌম, অমিতাভ অধিকারী, আনন্দ মোহন রায়, প্রশান্ত কুমার চক্রবর্তীর নাম ব্যবহার করে এবং নিজ নামে মোট ৬৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকার বিনিয়োগ আছে প্রশান্তর। অর্থাৎ ৮টি কোম্পানি ও প্রশান্তর আত্মীয় ও কর্মচারীদের নামে ৬৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এর সপক্ষে আয়ের বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি।
আয়কর নথিতে প্রশান্তর ৩২ কোটি ২৫ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক। ওইসব সম্পদের বৈধ উৎস দেখানো হয়নি। এছাড়া ধানম-িতে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি ফ্ল্যাট, ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দামের আরেকটি ফ্ল্যাট ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬১ কোটি টাকা দামের ৩১৬৫ শতাংশ জমি ও ভবন রয়েছে প্রশান্তর।
দুদকের এজাহারে বলা হয়েছে, প্রশান্তর নামে-বেনামে ১৮৭ কোটি ৭৮ লাখ ৫২ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ, ৯৯ কোটি ৬১ লাখ ২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট সম্পদের পরিমাণ ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার। অনুসন্ধানের সময় পাওয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সালে তার বার্ষিক মূল বেতন ছিল ৪৮ লাখ টাকা। এই হিসাবে ১৯৯৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বৈধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এটা বাদ দিলে তার কাছে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ আছে।
প্রশান্ত অবৈধ ব্যবসাসহ বিভিন্ন অবৈধ উৎস থেকে অর্জিত সম্পদের বেশির ভাগই বিদেশে পাচার করেছেন। তার এসব সম্পদের বিষয়ে মামলার তদন্তের সময় আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগের মাধ্যমে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হবে বলে দুদক জানিয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ জানান, অনুসন্ধানের সময় প্রশান্তকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য কয়েক দফা নোটিস দেওয়া হলেও তিনি হাজির হননি। তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে রয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছে কমিশন।
মন্তব্যসমূহ