ব্যবসা হোক আলেমদের কর্মক্ষেত্র, মাদরাসা মসজিদ হোক খেদমতের স্থান।
এইচ,এম ইমরান কাজী
প্রধান সম্পাদক :তাওহীদ নিউজ২৪
তাওহীদ নিউজ২৪:জীবিকার ত্যাগীদে ও পরিচয় তৈরি করতে বেঁচে নিতে হয় প্রয়োজনীয় পেশা। ব্যবসা, চাকরিসহ পৃথিবীতে রয়েছে শত শত রকমের পেশা। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয় পেশাও। কেউ বা স্বাধীন আবার কেউ বা পরাধীন পেশা বেচে নেয় ক্যারিয়ার গঠনে। আবার অনেকে উদ্যোগ নেয় নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরির।
আর ইসলামের দিকনির্দেশনা হল হালাল পথে জীবিকা উপার্জন করা। হারাম পথে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ ভোগ করে ইবাদত-বন্দেগী করলে তা আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না। কারণ ইবাদত কবুলের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল হালাল উপার্জন।
তবে একজন আলেম ব্যবসায় আত্মনিয়গ করতে চাইলে সাধারন মানুষ, ক্ষেত্রবিশেষ স্বগোত্রের অনেক আলেমও বিষয়টি আড় চোখে বা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে। ভেবে নেয় সে ভাল আলেম হয়নি কিংবা ভাল পড়া- লেখা করেনি। তাই ব্যবসা-বানিজ্য করছেন।
অথচ ইমাম আবু হানিফা রহ. একজন বিজ্ঞ আলেম ও মাযহাবের ফকীহ ইমাম ছিলেন। সাথে সাথে ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী।
রাসুল সা. এর বহু সাহাবী ব্যবসায়ী ছিলেন, দ্বীনি বড় বড় খেদমতের পাশা পাশি ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। স্বয়ং রাসুল সা.ও ব্যবসা করতেন।এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ঐ সকল ব্যবসায়ী ছাহাবীর মাধ্যমেই অবিমিশ্র-নির্ভেজাল ইসলামের আগমন ঘটে। মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ব্যবসা-বাণিজ্য। সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ইত্যাদির উপস্থিতি অতীব জরুরি। সততার সাথে হালাল উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহিত করে মহান আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সূদকে হারাম করেছেন।” [বাক্বারাহ ২৭৫]
কিন্তু আমাদের সসমাজের বাস্তব চিত্র ভিন্ন। যদি কোনো ইমাম বা খতিব তার ইমামতির পাশা পাশি ব্যবসা করেন, তো সামাজিক ভাবে আপত্তি তোলা হয়, একজন ইমাম কিভাবে ব্যবসা করে? এটা কী একজন ইমামের জন্য মানায়? এমন ইমামের পেছনে আমরা নামাজ পড়বো কিভাবে? তার পেছনে নামাজ পড়ে মজা পাই না! কত অদ্ভুত ‘তাসাউফী’ মূল্যায়ন!! এটি সত্যিই দুঃখজনক বিষয়।
আর এ জন্য ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী উলামায়ে কেরামের এককেন্দ্রীক মানসিকতা। আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা মনের অজান্তে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছি যে, একজন মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্র শুধু মাদরাসা নিয়েই পড়ে থাকতে হবে। মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিনি করতে হবে। অন্য কোনো কর্মব্যস্ততায় লিপ্ত হওয়া আমাদের জন্য বেমানান কিংবা এক প্রকার নাজায়েয! তাই সাধারণ মানুষও আমাদের এই ধ্যান-ধারণা হৃদয়ে বদ্ধমূল করে নিয়েছে। তারাও ভাবে, হুজুরদের কাজ হলো ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকা। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে আমাদের শুনতে হয়, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। ‘
বাস্তবতা হলো, হালাল উপার্জনের যতগুলো পন্থা আছে তন্মধ্যে রাসূল সা. শ্রমলব্ধ ও ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত আয়কে সর্বোত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারন কোন মুসলমান যখন মিথ্যা, প্রতারনা ও খেয়ানতের আশ্রয় না নিয়ে পূর্ণ সততার সাথে ব্যবসা করে, তখন তার এ ব্যবসা একটি পবিত্র ইবাদতে পরিণত হয়। উলামায়ে কেরামও নিজেদেরকে এ কাতারে শামিল করে নিজেদের জন্য হালাল উপার্জনের একটা পথ তৈরি করতে পারতো।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে শুনেছি, দারুল উলূম দেওবন্দের অধিকাংশ উস্তাযের মাদরাসার খেদমতের পাশাপাশি হালাল উপার্জনের জন্য আলাদা ব্যবসা-বানিজ্য আছে। মাদরাসা তাঁদের খেদমতের স্থান, কিন্তু মূল উপার্জনের মাধ্যম ও কর্মক্ষেত্র হলো ব্যবসায়িক কার্যক্রম। কিন্তু আমরা এটা থেকে দূরে, বহু দূরে। হীনমন্যতা, সামাজিকতা, লজ্জা ও এককেন্দ্রীকতা আমাদেরকে এমন কঠিনভাবে গ্রাস করে নিয়েছে যে, আমরা এখন চাইলেও নিজেকে নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে নিতে পারি না। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটাও একটা, আমরা পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত ব্যবসা সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীসের সম্বোধনপাত্র হিসেবে নিজেকে পেশ করতে পারিনি। যখন এ আয়াত ও হাদীসগুলো পড়ি তখন আমরা নিজের অজান্তে এর সাথে সাধারণ মানুষকে ফিট করার ধ্যানে মগ্ন হয়ে যাই। অথচ একবারও ভাবি না যে, ওয়ারিসে নবী হিসেবে আমিই এই আয়াত ও হাদীসগুলোর প্রথম সম্বোধনপাত্র! বাস্তব জীবনে বাস্তবায়নেরর জন্য আমিই এর সবচেয়ে বড় হকদার!! সাধারণ মানুষ তো আমাকে দেখে শিখবে। কিন্তু আফসোস, মানুষ আমাকে দেখে শেখা তো দূরের কথা, আমাকে এর যোগ্যই মনে করে না! এ সুযোগ আমরাই তাদের তৈরি করে দিয়েছি।
করোনার এই সঙ্কটকালীন সময় হাজার হাজার আলেম কর্মহীন হয়ে পরেছে, যাদের ও বা খেদমত ঠিক আছে তারা মাসিক ওজিফা(বেতন) ঠিক মত পাচ্ছে না মানবেতর জীবনযাপন করছে,আবার কবে কর্মস্থান ঠিক হবে এটাও অনিশ্চিত বাকি দিনগুলী কি ভাবে কাটবে এটা আমাদের জানার বাইরে।এভাবে পরনির্ভর কর্মই আমাদের সুন্দর জীবন অভিসাপ্ত ও দাসত্বের জীবনে পরিনিত হয়েছে।
সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে ভাবার। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে ব্যবসা সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীস নিয়ে গবেষণা করার। ব্যবসা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দণ্ডায়মান হবে, যেভাবে দণ্ডায়মান হয় ওই ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছে ক্রয় বিক্রয়ও তো সুদ নেয়ারই মত। অথচ আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা ২৭৫)
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ।(সুরা নিসা ২৯)
‘এমন লোকেরা যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে।’ (সুরা নূর ৩৭)
‘পরিতাপ সে সব পরিমাণকারীদের জন্য, যারা লোকের কাছ থেকে পরিমাণে পুরোপুরিই গ্রহণ করে। কিন্তু তাদেরকে দেয়ার বেলায় পরিমাণে কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফীন ১-৩)
ব্যবসা সম্পর্কে হাদীস: হযরত রাফে ইবনে খাদিজ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা হুজুর সা. কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর নবী! মানুষের যাবতীয় উপার্জনের মধ্যে কোনটি সবচেয়ে পবিত্র? হুজুর সা. বললেন, মানুষ নিজ হাতে যা কামাই করে এবং হালাল ব্যবসার মাধ্যমে যা উপার্জন করে। (মেশকাত)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সা. বলেছেন, সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক এবং শহীদানদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিযি)
আজ যদি আলেমগণ ব্যবসাকে খাটো করে না দেখতেন এবং ব্যবসা করতেন তাহলে ব্যবসা ক্ষেত্রে আরো সততা ফিরে আসতো।
আলেমদেরকেও দ্বীনি খেদমত করতে গিয়ে কারো পা চাটতে হতো না। কারো কাছে কটুভাষা শুনতে হতো না। আর্থিকভাবে কারো কাছে খাটো হতে হতো না।
দেখা যায়, ইমাম, খতিব ও মাদরাসার উস্তাদগণ ক্ষেত্রবিশেষ জনসাধারণ এবং কমিটির অন্যায় ও অমানবিক কথা শুনতে হয়। ধমক শুনতে হয়। কেউ চাকরি টিকাতে গিয়ে কমিটির হাত পা ধরতে হয়। মান-সম্মান নষ্ট করতে হয়। যদি ব্যবসার মাধ্যমে আয়ের ভিন্ন উৎস তৈরি করা যেত তাহলে হয়তো এই প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হতনা।
ইজ্জত-সম্মান জলাঞ্জলি দিতে হতনা। ঈমান-আমল মজবুত হতো। তাকওয়া ফরহেজগারীর সাথে জীবন কাটতো। তাই বলবো ব্যবসার ময়দানে আলেমগণকে পদচারনা বাড়াতে হবে। তাহলে দ্বীনের যে কাজগুলো করবে সেগুলো খেদমত হিসেবে করতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
আসুন আলেমগণ ব্যবসার ময়দানে এগিয়ে যাই। ইনসাফের সাথে। সৎ ও সততার সাথে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দাও করুন। আমিন।
মন্তব্যসমূহ