বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা



বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা 

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের এই দেশ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত হয়। এদেশের আলেম সমাজ সহ অনেকেই এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাড়িয়ে দেশের মানুষকে পাকিস্তানী জালিম শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। অসংখ্য উলামায়ে কেরামগণ তাদের জান মাল ,শক্তি সামর্থ্য দিয়ে এ দেশের মাজলুম জনগণের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছেন। "১৯৭১ সালে 'মোনাফিকদের ক্ষমা নেই' শীর্ষক একটি সরকারি প্রচার পত্রের শেষে লিখা ছিল,আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, 'সত্যের জয় ও মিথ্যার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, বাঙালি এতে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। [১] "
"মুক্তিযুদ্ধ কালিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর সাক্ষাৎকার, যা মার্কিন টেলিভিশন এবিসির মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। ওই সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক বব ক্লার্কের এক প্রশ্ন থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, আলেম সমাজ মুক্তিযুদ্ধে জনগণের পাশে ছিলেন এবং সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করেছেন।[২]" ১৯৭১ সালে ইসলাম রক্ষার নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরাপরাধ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুসলমানদের তারা নির্যাতন করত 'বিধর্মী' ভেবে। "সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকারেণহাস লেখেন- 'কুমিল্লার নবম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে আমার সফর কালে আমি দেখেছি, পাঞ্জাবি অফিসারগণ বাঙালিদের ইসলামের আনুগত্যের প্রতি সব সময়ই সন্দেহ পোষণ করত। তারা বাঙালি মুসলমানদের কাফের ও হিন্দু বলত। [৩]"
মুলত,৭১ সালে ইসলাম ও মুসলমানই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। "শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লেখেন, 'এক মহিলা রোগীর কাছে শুনেছিলাম তিনি নামাজ পড়ছিলেন, সেই অবস্থায় তাঁকে টেনে ধর্ষণ করা হয়। আরেক মহিলা কোরআন শরিফ পড়ছিলেন, শয়তানরা কোরআন শরিফ টান দিয়ে ফেলে তাঁকে ধর্ষণ করে। [৪]" শুধু তাই নয় পাকিস্তানের করাচির অনেক আলেমও শেখ মুজিব তথা বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকার মাওলানা আব্দুস সালাম ১৯৭১ সালে করাচির ইউসুফ বিন্নুরী মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এক ছাত্র করাচি মাদ্রাসার ইমাম মুফতি মাহমুদ সাহেবকে প্রশ্ন করলেন, ‘হযরত মুজিব গাদ্দার কো গ্রেফতার কর লে আয়া, লেকিন আবি তক কতল বী নেহি কিয়া?’ প্রশ্ন শুনেই মুফতি সাহেব খুব ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,‘শেখ মুজিব গাদ্দার নেহি, অহ সুন্নি মুসলমান হে, ইয়াহিয়া আওর ভূট্টো শিয়া হে। হর সুন্নি মুসলমানে কি জান আওর মাল কি হেফাজত কর না হর সুন্নি মুসলমানকে লিয়ে ওয়াজীব হে’। বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ও বুযুর্গ আল্লামা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (র) এবং এমদাদুল হক আড়ইহাজারী ১৯৭১ সালে বলেছিলেন,"এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়,এটা হল জালেম আর মাজলুমের যুদ্ধ"। পাকিস্তানীরা জালেম আর এ দেশের বাঙ্গালীরা মাজলুম।
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক উনার মা উপন্যাসে সাফিয়া বেগমের কথা উল্লেখ করেছেন। সাফিয়া বেগম উনার ছেলে আজাদ কে পুরান ঢাকার জুরাইন পীরের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে প্রেরন করেন। এই জুরাইন পীরের অনেক মুরীদ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। সক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন অসংখ্য উলাময়ে কেরাম। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন আল্লামা হাফেজ্জি হুজুর, আল্লামা লুৎফুর রহমান বরুণী ,আল্লামা কাজী মুরতাসিম বিল্লাহ, আল্লামা মুফতি নুরুল্ল্যাহ, আল্লামা এমদাদুল হক আড়াই হাজারী, আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী॥ বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসা গুলির মধ্যে আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা হল চট্রগ্রামের জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসা॥ ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়াউর রহমান এই চট্রগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান কে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে পটিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক আল্লামা দানেশ কে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা হত্যা করে। "পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিশ্চিত হয় পটিয়া মাদ্রাসার আলেমরা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে, তখনি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সেই পটিয়া মাদ্রাসার উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা বর্ষণ করা শুরু করে॥ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এই বোমা বর্ষনে পটিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক আল্লামা দানেশ ও ক্বারী জেবুল হাসান সহ অনেকেই শহীদ হন। [৫]"
.
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আল বদর রাজাকার বাহিনীর হাতে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য দেশের একজন স্বনামধন্য মাওলানাও শহীদ হয়েছিলেন। উনার নাম - মাওলানা অলিউর রহমান। ১৪ ডিসেম্বর উনার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায় রায়ের বাজার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা বেয়নেট দ্বারা খুচিয়ে খুচিয়ে উনাকে হত্যা করে। ১৯৭২ সালে তৈরি শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকায় মাওলানা অলিউর রহমানের নাম আছে।
মাওলানা অলিউর রহমান ছিলেন আওয়ামী ওলামা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। শেখ মুজিব যখন ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষনা করেন তখন অনেকেই ৬ দফা কে ইসলাম বিরোধী বলে ঘোষনা দেয়। সেই সময় মাওলানা অলিউর রহমান, "ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা" নামক একটি বই লিখে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার কোন দাবীই যে ইসলামী বিরোধী নয় তা প্রমান করেন।
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা মুখলেছুর রহমানের কাছে কুমিল্লার চান্দিনা থানা পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয় এবং ১৩৯৫ জন পাক আর্মি আত্মসমর্পন করে। ১৯৭১ সালে মাওলানা মুখলেছুর রহমান চাদপুরের কচুয়া মাদ্রাসায় তাফসীরে জালালাইন পড়তেন। মাওলানা মুখলেছুর রহমান এর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট এর সনদ ক্রমিক নং ২০২০৬। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থানার জয়দা গ্রামের মাওলানা বাড়ির সবাই মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন। মাওলানা বাড়ির ছেলে মাওলানা হাবীবুর রহমান যিনি সরাসরী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন॥ উনার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট এর সনদ ক্রমিক নং ১০০৯॥ মাওলানা বাড়ির জামাই হাফেয মোহাম্মদ মহিউদ্দীন আহমদ ভারতীয় ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধা। উনার ক্রমিক নং ৯৫২। এইরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
"মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন করার জন্য রাজবাড়ী জেল খানার মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে গলা কেটে করে হত্যা করে তারপর তার পেটের মাঝখানে পাকিস্তানি পতাকা পুঁতে দিয়ে বলে, 'আভি শালা জয় বাংলা বোলো।'[৬]"পাবনা সদরের একজন বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ ছিলেন, মাওলানা কসিম উদ্দিন। [৭]"
শুধু তাই নয় ১৯৭১ সালে এই দেশে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা কেন্দ্রিক যে আলেমদের সংগঠন "জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ" ছিল উনারাও কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অনেক ফতোয়া দিয়েছিলেন। "১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রধান মুহাদ্দিস শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান (র) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন । পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার উনাকে জোর করে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর উনি বাংলাদেশে ফিরলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান খতীব হিসাবে নিযুক্ত করেন। [৮]"
১৯৭১ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদরের সবচেয়ে বড় কওমী মাদ্রাসার প্রধান মুহতামিম আল্লামা তাজুল ইসলাম (র)
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলায় অনেক বড় বড় আলেম উনার ফতোয়া শুনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। "অনেক মুক্তিযুদ্ধাকে আল্লামা তাজুল ইসলাম নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। [৯]"
.
১৯৭১ এ যদি অধিকাংশ মুসলিম মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী থাকতো তাহলে এই দেশ কোনোদিন স্বাধীন হতো না। ১৯৭১ এ মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গণে যাবার আগে আল্লাহর কাছে সালাত আদায়ান্তে মুনাজাত করে রওনা হয়েছেন। সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলি সহস্রাধিক পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন। বহুল প্রশংসিত সেই বইটির নাম ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’। এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের ইতিহাস। এ চেতনায় শত শত আলেমের অস্ত্র তুলে নেবার রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন মত ও পেশার লোকেরা অংশ গ্রহন করেছিলেন। বাংলার আলেম সমাজও এর থেকে দূরে ছিলেন না। ঐ আলেমরা কিন্তু আওয়ামীলিগ বা ছাত্রলীগ করতো না। উনারা শুধু দেশ মাতৃকার টানে ও নির্যাতীত নারীদের কে পাকিস্তানী হানদার বাহিনীর লালসার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। তথাকথিত কিছু ইসলামী দলের কতিপয় ব্যক্তির মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপকর্মের উপর ভিত্তি করে দয়া করে সকল আলেম উলামাদের কে রাজাকার আলবদর আল শামস বলে গালি দিবেন না।
:
লেখাটি লিখতে যে সমস্ত বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছে -
.
[১] বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র : ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৩২- ৩৩৬।
.
[২] এম আর আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি, বিস্তারিত পৃষ্ঠা নং - ১৬৭।
.
[৩] দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ, পৃ. ২৪।
.
[৪] একাত্তরের দিনগুলি, পৃ. ১২৩।
.
[৫] বেলাল মোহাম্মদ ; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র; পৃষ্ঠা - ৫৪,৫৫ ও ১০২॥
.
[৬] আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা - ৬১।
.
[৭] মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা- ১৪৭ -১৪৮।
.
[৮] শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান (র) এর জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ॥
.
[৯] ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (র) ও উনার সাথীবর্গ, লেখক - হাফিয মুহাম্মদ নুরুজ্জামান,ইসলামিক ফাউন্ডেশন,বাংলাদেশ॥

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হাফেজ মাহমুদকে দেখতে 75000 টাকা নিয়ে হাসপাতালে জননেতা শহিদুল ইসলাম বাবুল

চিকিৎসাধীন হাফেজ মাহমুদ এখন বাড়িতে কেন?

ইমামের টাকা আত্মসাৎ করার প্রতিবাদ করায় চাকরি গেল ইমামের।

নগরকান্দায় গ্রাম্য কাইজায় মাদ্রাসায় হামলা"