নারী বাদ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক
নারীবাদ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক
.
নারীবাদ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ -
.
ক) দর্শন হিসেবে নারীবাদকে গ্রহণ করতে হলে আগে আপনাকে নারীবাদীদের প্রিয় “পুরুষতন্ত্র তত্ত্ব” (Patriarchal Thesis)-কে মেনে নিতে হবে। পুরুষতন্ত্র তত্ত্ব হল এই বিশ্বাস যে – সভ্যতার শুরুতে থেকেই পুরুষরা এমন এক বৈষম্যমূলক সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলেছে এবং টিকিয়ে রেখেছে যার উদ্দেশ্য হল নারীকে অধীনস্ত করা, শোষণ করা, নির্যাতন করা এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা।
খ) “পুরুষতন্ত্র তত্ত্ব” মৌলিকভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক. এ দু’য়ের মধ্যে কোনভাবেই সমন্বয় করা সম্ভব না।
গ) সুতরাং নারীবাদ মৌলিকভাবেই ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।
.
কেন পুরুষতান্ত্রিকতার এই তত্ত্ব ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে বিষাক্ত, এবং দর্শন হিসেবে মৌলিকভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক?
.
১) পুরুষতান্ত্রিকতার এ তত্ত্ব নবুওয়্যাতের পুরো ব্যাপারটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। সব নবী-রাসূল আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম পুরুষ ছিলেন। হ্যা, আমরা জানি ইবন হাযমসহ আরো কয়েকজন আলিম বলেছেন নারীদের মধ্যে কেউ কেউ ওয়াহি পেয়েছিলেন। যদি আমরা এ কয়েকজনের মতকে গ্রহণও করি সেক্ষেত্রেও উপসংহার হল, অধিকাংশ; প্রায় ৯৯% নবী-রাসূল পুরুষ ছিলেন, আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম।
.
যদি পুরুষতন্ত্র তত্ত্বকে আমরা মেনে নেই, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে – নবী-রাসূলরা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম কি নারীর ওপর আধিপত্য ও কর্তৃত্ব করার জন্য তৈরি এই বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর অংশ ছিলেন?
.
২) পুরুষতান্ত্রিকতার এ তত্ত্ব আলিমদের অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। ইসলামী ইতিহাসের অধিকাংশ আলিম ছিলেন পুরুষ। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং সম্মানিতরা ছিলেন পুরুষ। আর তাদের রচনাবলীর দিকে তাকালে দেখবেন – তাদের সবারই এমন অনেক অবস্থান ছিল যেগুলো আধুনিক নারীবাদের দর্শন অনুযায়ী “চরম মাত্রার বিষাক্ত নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক বাকওয়াস” ছাড়া আর কিছুই না।
.
এই সব আলিম ও ইমামগণ কি নারীর ওপর আধিপত্য ও কর্তৃত্ব করার জন্য তৈরি এই বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর অংশ ছিলেন?
.
৩) “পুরুষতন্ত্র তত্ত্ব” প্রশ্নবিদ্ধ করে ইসলামী আক্বীদাকেই। যদি পুরষতন্ত্র মানবজাতির জন্য এতোই বিপুল পরিমাণ দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে থাকে, এতোই বিষাক্ত, ধ্বংসাত্মক, এবং গভীরে প্রোথিত সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে কেন কুর’আনে এ নিয়ে কিছুই বলা হল না? “মানবতার এই অভিশাপ” – এর ব্যাপারে কুরআন কেন কিছুই বললো না? রাসূলুল্লাহ ﷺ কেন এ বিষয়ে কিছু বললেন না? ফেমিনিস্টদের মতে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ শক্তিগুলোর মধ্যে পুরুষতন্ত্র অন্যতম। অথচ এই মারাত্মক বিষয়টার বর্ননা করার মতো একটা শব্দ আরবী ভাষায় নেই? মানবজাতিকে এই ভয়ঙ্কর অভিশাপ, শোষন আর নির্যাতনের ব্যাপারে সতর্ক করে একটি আয়াত, এক লাইন হাদিসও আসলো না? কেন?
.
এই নিয়মতান্ত্রিক শোষন ও নির্যাতনের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহতে কিছুই বলা হল না? তাহলে কীভাবে কুরআন ও সুন্নাহকে পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা মনে করা সম্ভব?
.
.
যৌক্তিকভাবেই একজন ফেমিনিস্টের মনে ইসলামের ব্যাপারে এই প্রশ্নগুলো উদয় হতে বাধ্য। আর এ কারণেই ফেমিনিস্টরা বিভ্রান্তির বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যেতে থাকে, এবং এক পর্যায়ে এদের অনেকেই ইসলাম ত্যাগ করে।
.
শুরুটা হয় নারীদের ব্যাপারে “অশুভ পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি লালনের কারণে” ইসলামি ইতিহাসের আলিমদের পরিত্যাগ করার মাধ্যমে। তারপর তারা নবী-রাসূলগণকে আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম আক্রমন করা শুরু করে। যেমন আমিনা ওয়াদুদ ইব্রাহিমকে আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম আক্রমন করেছে। আর তারপর তারা কুরআনের সমালোচনা করা শুরু করে – “আল্লাহ কেন কুরআনে নিজের ব্যাপারে পুরুষবাচক সর্বনাম ব্যবহার করলেন? কেন আল্লাহ প্রথমে আদমকে, একজন পুরুষকে সৃষ্টি করলেন? কেন আল্লাহ সূরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াত নাযিল করলেন?”* ইত্যাদি।
.
নারীবাদের আদর্শিক ভিত্তিপ্রস্থর এ পুরুষতন্ত্র তত্ত্ব সহজাতভাবেই একজন মুসলিমের মধ্যে বিশ্বাসের বিপর্যয় তৈরি করে। যার কারণে অনেক মুসলিম নারীবাদিই ক্রমান্বয়ে নানা গোমরাহীপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করা শুরু করে, এবং তাদের অনেকেই ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদে পরিণত হয়।
.
যারা দাবি করেন ইসলাম ও নারীবাদ সামঞ্জস্যপূর্ণ, এ দু’য়ের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব - তারা দয়া করে ওপরের তিনটি পয়েন্টের জবাব দেবেন। আপনাদের হাতে সম্ভাব্য উত্তর সীমিত। ব্যাপারটা আরেকটু সহজ করার জন্য আমি সম্ভাব্য এ উত্তরগুলোর লিস্ট দিয়ে দিচ্ছি। আপনি বলতে পারেন -
.
১) পুরুষতান্ত্রিকতার তত্ত্বে বিশ্বাস না করেও – অর্থাৎ সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই থেকেই নারীকে অধীনস্ত ও শোষণ করার জন্য পুরুষতন্ত্র কাজ করছে – এ তত্ত্বে বিশ্বাসী না হয়েও ফেমিনিস্ট হওয়া সম্ভব।
অথবা
২) পুরুষতন্ত্র তত্ত্ব আসলে ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না।
.
আপনি কোনটা বেছে নেবেন?
.
সংস্কারপন্থী, প্রগ্রেসিভ এবং কুরানিস্ট জাতীয় যারা আছে; ইসলামী ইতিহাসের আলিমদের সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে যাদের কোন সমস্যা নেই, তারা দু’ নাম্বারকে বেছে নেবেন। কিন্তু সঠিক আক্বিদার ওপর থাকা সাধারণ মুসলিমরা এ সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত ইলমি সিলসিলা (scholarly tradition) ছাড়া আমরা কুরআন পেতাম না, সুন্নাহ পেতাম না, ইসলাম সংরক্ষিত হতো না – যেহেতু সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন, হাদীস বর্ণনাকারী, আলিম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, এবং ফক্বিহদের প্রায় ৯৯% পুরুষ।
.
যদি আপনি আলিমদের ছুড়ে ফেলেন, আপনাকে ইসলামকেও ছুড়ে ফেলতে হবে। আলিমরা হলেন নবীদের আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম ওয়ারিশ। যদি কেউ দাবি করে, সারা বিশ্বজুড়ে ইসলামের আলিমরা সিস্টেম্যাটিকালি নারীর বিরুদ্ধে ছিলেন, এবং তাঁরা নারীদের ব্যাপারে না-ইনসাফি করেছেন – তাহলে সে আলিমদের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং কার্যত ইসলামকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
.
আমার মতে এটা নারীবাদ ও ইসলামের সহজাত সংঘর্ষের একটি যৌক্তিক পর্যালোচনা। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে যৌক্তিক খন্ডন উপস্থাপন করতে পারেন। তবে আবেগ ও বুলি সর্বস্ব ন্যাকামি, অ্যাড হমিনেম ঘ্যানঘ্যানানি আর রূপকথার রাজপুত্রসুলভ অভিনয় গ্রাহ্য করা হবে না।
.
বিঃদ্রঃ কিছু অস্পষ্টতা দূর করা যাক।
.
অবশ্যই পুরুষতন্ত্রের অস্তিত্ব আছে। অ্যানথ্রোপোলজিকাল বা নৃতাত্ত্বিক সেন্সে ইসলাম একটি পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। ইসলামী আইন অনুযায়ী বংশপরিচয় নির্ধারিত হয় পিতৃপরিচয় দ্বারাই । সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোরর কর্তৃত্ব থাকে পুরুষের হাতে, সেটা হতে পারে, গোত্রপতি, স্বামী, পিতা কিংবা অন্য কোন পুরুষ। কিন্তু নারীবাদের প্রচারিত “পুরুষতন্ত্র”- এর ধারণা আর অ্যানথ্রোপোলজিকাল বা নৃতাত্ত্বিক সেন্সে পুরুষতন্ত্রের ধারণার মধ্যে পার্থক্য আছে। নারীবাদ দাবি করে এসবগুলো কাঠামো সহজাতভাবেই নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ। ফেমিনিস্টদের দাবি হল, পুরুষরা এসব পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলেছে নারীর স্বার্থের বিনিময়ে পুরুষের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য।
.
অর্থাৎ, নিষ্পাপ, সাদাসিধে, দুর্ভাগা নারীদের প্রতি পদেপদে আটকে রাখার জন্য, শোষণ করার জন্য, একদল শয়তান লোক, ক্রমাগত চক্রান্ত করে চলেছে। সভ্যতার শুরু থেকে চলে আসলেও মাত্র কয়েক দশক আগে ফেমিনিস্টদের কল্যাণে এই কাপুরুষোচিত মহাষড়যন্ত্রের বাস্তবতা মানবজাতির সামনে প্রকাশিত হয়েছে। আর সেই থেকে পুরুষতন্ত্র নামের এই শয়তানী চক্রান্ত নস্যাৎ করার দুঃসাহসী, বীর ফেমিনিস্টরা খেয়ে না খেয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
.
পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে? হওয়াটাই স্বাভাবিক।
---
সত্যকথন ডেস্ক
ড্যানিয়েল হাক্বিকাতজু-র লেখা অবলম্বনে।
* সূরা নিসা,আয়াত ৩৪ঃ
পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের এককে অন্যের উপর মর্যাদা প্রদান করেছেন, আর এজন্য যে, পুরুষেরা স্বীয় ধন-সম্পদ হতে ব্যয় করে। ফলে পুণ্যবান স্ত্রীরা (আল্লাহ ও স্বামীর প্রতি) অনুগতা থাকে এবং পুরুষের অনুপস্থিতিতে তারা তা (অর্থাৎ তাদের সতীত্ব ও স্বামীর সম্পদ) সংরক্ষণ করে যা আল্লাহ সংরক্ষণ করতে আদেশ দিয়েছেন। যদি তাদের মধ্যে অবাধ্যতার সম্ভাবনা দেখতে পাও, তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদের সাথে শয্যা বন্ধ কর এবং তাদেরকে (সঙ্গতভাবে) প্রহার কর, অতঃপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়, তাহলে তাদের উপর নির্যাতনের বাহানা খোঁজ করো না, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ঠ।
মন্তব্যসমূহ